আজ || রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫
শিরোনাম :
  গোপালপুরে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা       ধনবাড়ি মডেল প্রেসক্লাবে সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদ ও দোয়া       গোপালপুরে মরহুম আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট       টাঙ্গাইল-২ আসনে গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থী শাকিল উজ্জামান       গোপালপুরে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ       গোপালপুরে শিক্ষার্থীদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করেন সালাম পিন্টু       গোপালপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ছাত্রদলের বিক্ষোভ       গোপালপুরে যথাযোগ্য মর্যাদায় জুলাই শহীদ দিবস পালিত       গোপালপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল       গোপালপুরে প্রতিপক্ষের হামলায় ১২ মামলার আসামি চাকমা জাহাঙ্গীর নিহত    
 


ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি বাগদী; খাবার সংগ্রহে স্কুল কামাই দিয়ে ইঁদুরের সাথে লড়াই

 

জয়নাল আবেদীন :

Photo-Gopalpur-Tangail 13.12.2015

আলতো হাতে শাবল চালিয়ে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ধান উঠাচ্ছিল ওরা। কাঁদায় লেপ্টে থাকা এক গুচ্ছ ধানের শীষ টেনে বের না করতেই চিক শব্দে গর্ত থেকে লাফিয়ে বেরুলো জোড়া ল্যাংড়া ইঁদুর। শপাং শব্দে শাবলের গুঁতোয় ছেঁচে দিলো দুটোই। আবার গর্ত খোঁড়াখুড়ি। মূল ভান্ডারে গচ্ছিত রয়েছে ধান। ইঁদুরের সঞ্চিত সেই ভান্ডারের সবটাই চাই। এ ধানের চালে পিঠা হবে। হবে খেসারি ডালের খিচুড়ি। তাই স্কুল কামাই করে প্রানান্তকর চেষ্টা ওদের। বলছিলাম গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃর্তীয় শ্রেণীর ননী আর সূচনার কথা। দুজন পিশাতো ভাইবোন। গত সোমবার ৭ ডিসেম্বর ঝাওয়াইল-পাকুটিয়া সড়কের অদূরে আমন ক্ষেতে কর্মরত দেখা যায় ওদের। ননীর বাবা রতন চন্দ্র। সূচনার বাবা নিত্য চন্দ্র। সম্প্রদায়ে বাগদী। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির একটি। প্রথমে ওই দুই শিশু কথা বলতে অনিচ্ছুক। পরে মাথা নিচু করে সাড়া দেয় ওরা। ননী জানায়, আমন মৌসুমে বড়দের সাথে তারাও ধান সংগ্রহে বের হয়। কদিন ধরে বড়রা ধান কাটার কামলা দেয়া আর লাকড়ি চিড়ানো নিয়ে ব্যস্ত। শীতের পিঠা খেতে চাইলে মায় কইলো চরায় যা। ধান নিয়ে আয়গে। তবেই পিঠা।’সূচনা জানায়, মামী বলছে ধান আইনলে পর খেসারি ডাইলে খিচুড়ি অইবো। তাই আইছি।’গর্তের ধানের ছড়া বের করা মাত্র সূচনা গায়ের ফ্রকের নিচের অংশ মেলে তাতে রাখছিল। শুধু ননী আর সূচনা নয়। গোপালপুর উপজেলার সব বাগদী পল্লীর একই দৃশ্য। ধানপাঁকার মৌসুমে মাঠে ইঁদুরের সাথে লড়াই চালিয়ে ধান সংগ্রহ করে বাগদীরা। তাতে যোগ দেয় শিশুরাও। এজন্য প্রায়ই স্কুলে যাওয়া হয়না। আমন মৌসুমে সংগ্রহ করা ধানকে ওরা বলে ‘রাজার ধন’। তাদের  বিশ্বাস এটি প্রকৃতি প্রদত্ত। এ ধনে হক শুধু তাদের। ওই দিন কৌতূহলবশত ঝাওয়াইল বাগদী পল্লীতে গিয়ে দেখা গেল তাদের যাপিত জীবন। ঝাওয়াইল মোড় থেকে একটু এগুলে হাতের বায়ে সরু গলি। তৃতীয় বাড়ি থেকেই বাগদী পল্লী। ৪০ শতাংশ খাস জমিতে ৩৫ ঘর বাগদীর গাদগাদি বাস। দিন আনে দিন খায়। কামলা খাটে, লাকড়ি চিরায়, সেলুন বা হোটেলে কাজ করে। পাড়ার দিগেন চন্দ্র বাগদী (৭০) জানান, ইংরেজ শাসনামলে নাটোরের জমিদার রানীভবানী ঝাওয়াইল বাজারে নায়েব কাচারী প্রতিষ্ঠা করেন। নায়েব বাবুরা খাজনা আদায়ে পালকি বা ঘোড়ায় চড়ে এলাকায় যেতেন। অবাধ্য প্রজা শায়েস্তায় লাঠিয়ালের প্রয়োজন হতো। এ জন্য ভারতের বিহার ও উডিষ্যা থেকে আনা হয় বাগদীদের। যতীন বাগদী জানান, পূর্ব পুরুষদের বলা হয়েছিল, ‘তোরা বাংলা মুলুকে গেলে দামি চাকরি পাবি,, ভালো খাবার পাবি, রাজবাড়ির আঙ্গিনায় বউবাচ্চা নিয়ে থাকতি পারবি।’ কিন্তু তাদের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। এখানে লাঠিয়ালি, ঢুলি, পালকি বাহক অথবা পেয়াদাগিরি পেশা বেছে নিতে হয়। নায়েব কাচারির পাশেই থাকার ব্যবস্থা হয়। গড়ে উঠে বাগদী পল্লী। এভাবে কেটে গেছে দেড়শতক। উনবিংশ পেরিয়ে বিংশ। বিংশ পেরিয়ে একবিংশের দ্বিতীয় দশক। বংশ পরম্পরায় ষষ্ঠ পুরুষরা সেই ভিটেয় দিন যাপন করছে। যে অভাব তাড়িয়ে সুখের আশায় পূর্বপুরুষরা বাংলা মুলুকে এসেছিল উত্তরসূরিরা ওই যাতনা আরো বেশি করে ভোগ করছে।  ভারতবিভক্তির পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে নায়েব কাচারি বন্ধ হয়ে যায়। তৃতীয় প্রজন্মের বাগদীরা মাটির টানে এদেশে থেকে যায়। নায়েবগোমস্তরা না থাকলেও অভিজাত পর্দানসীন মুসলমান বউঝিরা ঢুলি বা পালকিতে স্বামী বা বাপের বাড়ি আসা যাওয়া করতো। তাই এ পেশায় নতুন করে টিকে থাকার সন্ধান পায় ওরা। কিন্তু যান্ত্রিক বাহনের প্রচলন ঘটলে ঢুলি-পালকির প্রচলন বন্ধ হয়ে যায়। ওরা দ্বিতীয় দফায় বেকার হয়। তখন থেকেই দুর্দশার শুরু। একদিকে অর্থনৈতিক টানাপোড়ন অন্যদিকে জমিদারের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি খাস হিসাবে ঘোষণা দেয়ায় মাথাগোঁজার ঠাঁই নিয়ে জবরদখলের পালা শুরু হয়। স্বপন চন্দ্র বাগদী জানান, এরশাদ আমলে প্রভাবশালীরা বাগদী পল্লীতে অগ্নিসংযোগ করে তাদের উচ্ছেদ করে। পরে ভারতীয় দূতাবাসের হস্তক্ষেপে একাংশ ছেড়ে দিয়ে তাদের আপোষ করতে হয়। বহু চেষ্টাতেও বসতভিটার জমি লিজ নিতে পারেনি। বাগদীরা সব সময় উচ্ছেদ আতঙ্কে থাকে। রতন বাগদী জানায়, পেটে ভাত জোটেনা। পরনে কাপড় থাকেনা। তাই বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানোর সাধ্য থাকেনা। এজন্য বাগদী শিশুরা স্কুল কামাই দিয়ে রাজার ধান সংগ্রহে মাঠে  ঘুরে বেড়ায়। দুই দশক আগেও পাড়ার সবার পেশা ছিলো গর্তের ধান আর জঙ্গলের আলু সংগ্রহ করা। এখন জঙ্গল কইমা যাওয়ায় বন আলু পাওয়া যায়না। পাড়ার ২০ ঘর এখনো ইঁদুরের গর্ত খুড়ে ধান সংগ্রহের পেশায় জড়িত। সাধারনত রোপা আমন মৌসুমেই বেশি ধান পাওয়া যায়। অনেকেই সংগ্রহ করা ধানে তিন চার মাসের খোরাকি চালায়। কথা হয়, গোবিন বাগদীর সাথে। জানায়, ‘অহন তেমন ধান পাওয়া যায়না। গৃহস্তরা কামলা লাগিয়ে নিজেরাই গর্তের ধান সংগ্রহ করে। আমরা ক্ষেতে নামলে বাঁধা দেয়। হের পরেও পাড়ার ছাওয়ালরা অগ্রহায়নপৌষে একাজে ব্যস্ত থাকে। লেখাপড়া শিখে কি অইবো। আমাগো পাড়ায় দুজন মেট্রিক পাশ দিছে। কোথাও চাকরি অইছেনা। তাহলি পইরে কি হবি?  বাগদীরা গোপালপুর উপজেলার বর্ণ হিন্দুদের নিকট যেমন অচ্ছুত। তেমনি মুসলমানদের নিকট ছোটজাত। চায়ের দোকান বা হোটেলে ওদের জন্য আলাদা থালগ্লাস বা কাপপিরিছ থাকে। শিশুরা স্কুলে গেলেও ছোটজাত বলে খেলতে চায়না অনেক সহপাঠি। এজন্য হীন মন্যতায় ভোগা বাগদী  শিশুরা লেখাপড়ায় অমনোযোগি। ‘স্কুল তাদের জন্য আনন্দ গৃহ নয়’, বললেন পাড়ার লক্ষি বাগদী।

মন্তব্য করুন -


Top
error: Content is protected !!